সালাত আদায় করার সময় লক্ষ্যনীয় বিষয় কি কি? কাপড় গুটিয়ে নামাজ পড়া যাবে কি?
কাফফে সাওব কাকে বলে?
ফিক্হ’র পরিভাষায় সেজদায় যাওয়ার সময় কাপড় উপরের দিকে টানা, কোমরের দিকে বা পায়ের দিকে ভাঁজ বা মরানো ও আস্তিন কে বা জামার হাতা আধা কব্জি থেকে অধিক উপরে তোলাকে কাফফে সাওব বলে। হাদীস শারীফ ও ফিক্হ শাস্ত্রের অনুসারীগন এ বিষয়টিকে মাকরূহ-ই-তাহরীমী বলেছেন। এ অবস্থায় সালাত পড়লে সালাত ত্রুটিপূর্ণ হয়। কাপড়কে স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে সালাত পুনরায় পড়ে নেয়াটা তার জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত দলিল পেশ করার আগে কিছু কথা জেনে নিন। যখন আপনি সালাত আদায় করার জন্য ইচ্ছা করেন, মূলতঃ তখন আপনি মহান আল্লাহ্র দরবারে হাজির হচ্ছেন। যে দরবার হতে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন আর কোন দরবার নেই। একারনে এ দরবারে অতি আদবের সাথে আসা উচিত। এরূপ নয় যে, মনে হচ্ছে একজন অসভ্য, অসামাজিক, মূর্খ, বেয়াদব উপস্থিত হচ্ছে। আদব এটাই যে, পোষাক পরিচ্ছদ যথাযথ ভাবে পরিধান করে হাজির হওয়া।
উদাহরণের স্বরূপ, ‘‘যদি আপনাকে কোন অফিসারের সম্মুখে যেতে হয় প্রথমে নিজেকে সর্ব দিক দিয়ে যথার্থ ও ঠিক ঠাক করে নিতে হয়। নিজের শরীরের পোষাককে সর্ব দিক দিয়ে সাজিয়ে নিতে হয়। আস্তিন উঠানো থাকলে সেটাকে খুলে সোজা করে নিতে হয়। প্যান্টের পা ইত্যাদি ঠিক করে নিতে হয়। যদি প্যান্টের এক প্রান্ত উপরের অন্যটা নীচের দিকে, তাহলে সেটাকেও ঠিক নিতে হয়। যখন দুনিয়ার কোন অফিসারের রুমে যাবার জন্য এরূপ করেন, তাহলে যেটা সকল দরবারের চেয়ে সর্বাধিক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন দরবার। সে দরবারে যাচ্ছেন তো এর চেয়ে অধিক হওয়া উচিত। নাকি এর বিপরীত করবেন? বরঞ্চ এ সময় অনুনয় ও বিনয়ের অবস্থা অসাধারণ রূপ হওয়া উচিত।’’ কেননা আল্লাহ্ পাকের প্রিয় মাহবূব, সারকারে কায়িনাত।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ইরশাদ করেন, ‘‘তুমি আল্লাহতালার ইবাদাত এমন ভাবে কর যে, মূলত তুমি তাকে দেখছো এবং যদিও তুমি তাঁকে দেখছো না তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি তোমাকে দেখছেন।”
আল্লাহতালা নিজেই ইরশাদ করেন- ‘‘আল্লাহতালার সম্মুখে আদব সহকারে দন্ডায়মান থাক।’’
আপনার যেন এমন অবস্থা না হয় যে, এক দিকের প্যান্টের পা উপরে এবং অন্য দিকের টা নীচে। যা আপনি সাধারণ অবস্থায় মোটেও পছন্দ করেন না।
প্রশ্নঃ (১) পুরুষের প্যান্ট ,পায়জামা ও লুঙ্গি ইত্যাদি লম্বা হওয়ার দরুন অনেকে সালাত পড়ার জন্য সেগুলো টাখনুর উপরে উঠিয়ে নেয়ার জন্য পায়ের দিকে কিংবা কোমরের দিয়ে গুটিয়ে বা মড়িয়ে নেন। এছাড়া জামার হাতাও ভাঁজ করে কব্জির উপর উঠিয়ে নেন। শরিয়াতের দৃষ্টিতে এরূপ করা কেমন ?
উত্তরঃ হযরত সায়্যিদুনা ইমাম বোখারী (রঃ) সাহীহ্ বোখারী শারীফে বিশেষভাবে এ মাসআলার জন্য একটি অধ্যায় নির্ধারণ করেছেন।
ইমাম বোখারী (রঃ) এ অধ্যায়ে একখানা হাদীস শরীফ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন যে, “আমার উপর হুকুম হয়েছে যে, সাতখানা হাঁড়ের উপর সেজদা করার এবং এটাও হুকুম হয়েছে যে, কাপড় ও চুল না মড়ানোর।” আর ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী (রঃ) বলেন, এ হাদীস খানা হাসান ও সাহীহ্। এ হাদীস শারীফের ব্যাখ্যায় স্বীয় যুগের আযীমুল মার্তাবাত মুহাদ্দিস, শারিহ্ বোখারী, আ’ল্লামাহ্ বাদরুদ্দীন আইনী (রঃ) ইরশাদ করেছেন-
‘‘আবূ দাউদের নিকট কাফফে সাওব’র মাকরূহ-ই-তাহরীমী হওয়ার অত্যন্ত উত্তম সনদে এক বর্ণনা রয়েছে। সেটা এ যে, হযরতে আবূ রা-ফি’ (রাঃ) কে দেখলেন যে, আপন বাবরী চুল নিজ গর্দানে চুলের গদি বানিয়ে সালাত আদায় করেছেন। তখন আবূ রা-ফি (রাঃ) সেগুলোকে খুলে দিলেন এবং বললেন যে আমি নবী কারীম (সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, চুরের গদি শায়তানের আসন। ‘মারফা’ নামক কিতাবে আমরা সাবিত (রাঃ) এর হাদীস বয়ান করেছি, যেটা আবদুল্লাহ বিন হারিস (রাঃ) কে দেখলেন যে তিনি নিজের চুলের গদি বানানো অবস্থায় সালাত পড়ছেন তখন আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রাঃ) চুলের গদি খুলতে লাগলেন এবং বললেন, আমি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, এটা শায়তানের আসন। সুতরাং এ হাদীস এ অবস্থায় সালাত পড়া অপছন্দের প্রমাণ করছে। অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এর ঐক্যমত যে, হুযূর (সাঃ) এর নিষেধ করা প্রত্যেক ঐ সালাতের জন্য এটা করুক বা শুরু হতেই এরূপ করা বস্থায় থাকুক। সুতরাং এ হাদীস হতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কাপড় এবং চুল দুটোতেই সালাত পুনরায় পড়া ওয়াজিব হয়ে যায়।
ফাক্বীহ্গণ ও সালীহীন ক্বিরামের বাণী সমূহঃ
>> আল্লামা ইবনে ‘আবিদিন শামী (রাঃ) লিখেন-‘‘কাপড়কে উঠানো যদিও কাপড় মাটি হতে বাঁচানোর জন্য হোক। যেমন আস্তিন এবং দামন আচল মড়ানো। যদি এ অবস্থায় সালাতে প্রবেশ করল যে তার আস্তিন বা তার দামন মড়ানো ছিল তখনও মাকরূহ। একথা হতে ঐ কথার দিকে ইশারা করা উদ্দেশ্য যে, এ মড়ানো সালাত অবস্থার সাথে বিশেষ ভাবে নির্ধারিত নয়। চাই সালাত শুরু করার পূর্ব হতে বা সালাতের মধ্যখানে হোক সর্বাবস্তায় মাকরূহ (খন্ড-১ম. পৃষ্ঠা-৫৯৮)
>> জাওয়াহিরাতুন নায়য়িরাহ্ নামক কিতাবে রয়েছে –
‘‘কাফফে সাওব এটা নয়, যে নিজে কাপড়কে না মড়ায় বরং কাফফে সাওব এটা যে, সেজদা করার সময় নিজের সম্মুখ হতে বা পিছন হতে কাপড় উঠানো’’ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন যে,‘‘আমায় হুকুম হয়েছে যে, আমি সাতখানা হাড্ডির উপর সেজদা করবো, কাপড় ও চুলকে জড় বা একত্রিত করবো না।’’ (খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-৮১)
>> সাগিরী শারহে মুনিয়াতুল মুসাল্লীতে রয়েছে- সালাত অবস্থা্য় নিজ কাপড় আঁকড়িয়ে ধরে সালাত আরম্ভ করা, মাটি হতে বাঁচানোর জন্য কাপড় উঠানো, এসব মাকরূহ।(পৃষ্ঠা-১৮৯)
>> আলমগীরিতে রয়েছে – সালাত আদায়কারীকে নিজের কাপড় বা দাঁড়ি বা শরীর নিয়ে খেলা করা মাকরূহ এবং কাপড়কে একত্রিত জড় বা ভাঁজ করাও মাকরূহ। এভাবে সেজদায় যাওয়ার সময় নিজের সম্মুখ বা পিছন হতে কাপড় উঠিয়ে নেয়া। এথেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কাপড় জড় করা সালাতে সেজদায় যাওয়ার সময় নিজের বা পিছনের কাপড় জড় বা ভাঁজ করা সালাতে এভাবে প্রবেশ করল যে তর দামন (আঁচল) বা আস্তিন মরানো ছিল বা মাটি হতে বাঁচানোর তাগিদে উঠিয়ে নিল, এগুলি সব মাকরূহ এবং ফুক্বহায়ে কিরাম সাধারণতঃ মাকরূহ বলে মাকরূহ-ই-তাহরীমী উদ্দেশ্য নেন। (খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-১০৫)
>> হিদায়া এবং তাবিনুল হাক্বায়িক্বে রয়েছে –
‘নিজ কাপড়কে যেন একত্রিত বা জড় না করে, কেননা এটা এক প্রকারের অহংকার’। (হিদায়া- খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-১০১, তাবিন- খন্ড-১ম , পৃষ্ঠা-১৫৪)
পবিত্র কোরআনের বাণী – ‘‘ আল্লাহ পাকের সম্মুখে আদব ও বিনয়ের সহিত দাঁড়াও’’।
এ সব হাদীস ও ফিকাহ উক্তি হতে সকল মুসলমানের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত এবং নিজের সালাত সমূহকে নষ্ট হওয়া হতে বাঁচানো উচিত। প্রত্যেকের উচিত যেন নির্ভর যোগ্য কিতাব সমূহে বর্ণিত মাসআলার উপর আমল করে। মনগড়া ও ভিত্তিহীন কথা-বার্তা পরিহার করে। সকল মসজিদের ইমাম সাহেবদের প্রতি আবেদন এই যে, এটার উপর নিজে আমল করুন এবং নিজ মুসল্লীদেরকেও আমলের শিক্ষা দান করে আল্লাহ পাকের নিকট থেকে পুরস্কৃত হউন।
অভিযোগ সমূহঃ
(১)প্রশ্নঃ যদি আস্তিন আধা কব্জি হতে কম মড়ানো হয় তাহলে সালাত কি মাকরূহ-ই-তানযীহী হয় এবং আধা কব্জি বা এর চেয়ে বেশী মড়ানো হলে কি মাকরূহ-ই-তাহরীমী হবে?
উত্তরঃ সাধারণ ভাবে আস্তিন মড়ানো কাফফে সাওব, যাতে সালাত মাকরূহ-ই-তাহরীমী ওয়াজিবুল ইয়া’দাহ্ হয় কিন্তু আল্লামা ইবনে আবিদিন শামী (রাঃ) এটা বিস্তারিত বায়ান করেছেন। অর্ধ কব্জি হতে কম হলে সালাত মাকরূহ-ই-তানযীহী হয় এবং অর্ধ কব্জি এর চেয়ে আস্তিন মড়ানো হলে সালাত মাকরূহ-ই-তাহরীমী হয়। আল্লামা শামী (রাঃ) এর কারণ বলেছেন যে, সাধারণত অযূ করার পর বে-খেয়ালী বা বে-পরোয়ার কারণে আস্তিন কিছুটা মড়ানো থেকে যায় অতএব সর্ব সাধারণের সুবিধার্থে ছাড় দেয়া হয়েছে।
(২) প্রশ্নঃ ‘আক্বস’ এর অর্থ চুল সমূহ বা কাপড় সমূহকে গুছিয়ে নিয়ে বা একত্র করে কোন জিনিস দিয়ে বাধা। যখন মড়ানোর মধ্যে এ কথা হয়না অতএব এতে মাকরূহ না হওয়া উচিত ?
উত্তরঃ যার সামান্য জ্ঞান রয়েছে সে ব্যক্তি জানে যে, বাঁধার উদ্দেশ্য কি হয়। এটাও হয় যে, যেকোন পন্থায় রুখে দেয়া। এখানেও পায়জামা উপরের দিকে মুড়িয়ে রুখে দেয় এবং প্যান্টের পায়ের কাপড় উপরের দিকে মুড়ানো হয় যা মাকরূহ্ পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত।
(৩) প্রশ্নঃ কিছু উলামা এবং সাধারণ মানুষ একথা বলেন যে, এ কাজ যদি সালাত অবস্থায় অর্থাৎ সালাতের ভিতর করা হয় তাহলে সালাত মাকরূহ-ই-তাহরীমী ওয়াজিবুল ইয়া’দাহ হবে?
উত্তরঃ এরূপ কথা যিনি বলেন , তিনি ভীষণ ভুলের উপর রয়েছেন। এটা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার শামিল। বোখারী শরীফের বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বাদরুদ্দীন আ’ইনী (রাঃ) লিখেন –‘‘অধিকাংশ ওলামায়ে কিরাম কাফফে সাওব ও কাফফে শার কে মাকরূহ-ই-তাহরীমী সাব্যস্ত করেছেন। এ আমল তার সালাতের ভিতর হোক বা শুরু করার পূর্বে হোক। হযরত ইমাম হাসান বসরী (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, এভাবে সালাত আদায় করাতে তা পুনরায় পড়া জরুরী হয়ে যায়।
নিজ কাপড়সমূহ বা চুলসমূহ এক জায়গায় জমা করে সুতা দিয়ে বাঁধা বা আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়া। উপরোক্ত হাদীস শরীফ সমূহ ও ফিকহের উক্তি সমূহের আলোকে এটা মাকরূহ-ই-তাহরীমী হওয়া সুস্পষ্ট প্রমানিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করা প্রত্যেক ইমাম সাহেব ও মুসল্লীগণের উপর একান্ত দায়িত্ব। অলসতা ও অবহেলা, অজ্ঞতার নামান্তর। পরম করুণাময় সবাইকে বোঝার তাওফিক দান করুন। যেমন হাফ বা অর্ধ হাতা ওয়ালা আস্তিন সহকারে সালাত পড়া তদ্রুপ শার্টকে প্যান্টের ভিতর রেখে সালাত পড়া আদবের পরিপন্থি-খিলাফে আওলা। আরো উল্লেখ থাকে যে, যারা অজ্ঞতাবশত কাপড় টাখনু নীচে পরা অবস্থায় বা কাপড় কোমর বা পায়ের দিকে গুটিয়ে বা মড়িয়ে সালাত আদায় করে আসছেন অতীতের অজ্ঞতাবশত আদায়কৃত সালাত সমূহ পুনরায় পড়তে হবে না। বরং আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থণা করবেন এবং ভবিষ্যৎতের জন্য হুশিয়ার থাকবেন। -অসিয়ে আহলে সুন্নাত।
(৪)প্রশ্নঃ প্যান্ট পায়ের দিকে গুটিয়ে নিলে যদি সালাত মাকরূহ-ই-তাহরীমী হয়, তবে কোমরের দিকে গুটিয়ে নেয়া যাবে কি? কেননা লুঙ্গিতো এমনিতেই মড়িয়ে পরিধান করা হয়।
উত্তরঃ উপমহাদেশের প্রখ্যাত ‘আলিম আল্লামা আব্দুস্ সাত্তার হামদানী’ (মাদ্দাজিল্লুহুল আলী) ‘‘মু’মিন কী সালাত’’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন যে-‘‘এ মাসআলার ব্যাপারে সাধারণ লোকেরা অত্যন্ত ভুলের মধ্যে রয়েছে যে, অনেক লোককে দেখা যায় সালাত আদায় কালে প্যান্ট বা পায়জামাকে গোঁড়ালীর উপরে উঠানোর জন্য প্যান্ট বা পায়জামার নিচের দিক উপরের দিকে মুড়িয়ে দিয়ে থাকে। সালাতের মধ্যে এভাবে প্যান্ট ও পায়জামার নিচের অংশ মুড়িয়ে উপরে তুলে দেয়াকে খিলাফে মুতাদ বা স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থি। এতে সালাত মাকরূহ-ই-তাহরীমী হয়। যদি প্যান্ট বা পায়জামা এত লম্বা যে, টাখ্নু ঢেকে যায় তবে টাখ্নু বা গোঁড়ালী দেখা যাওয়ার জন্য প্যান্ট বা পায়জামার নিচের দিক মুড়ানো অনুচিত। বরং সম্ভব হলে কোমরের দিক থেকে উপরের দিক থেকে টেনে নেবে। যদি কোমরের দিকে টেনে (তবে মুড়িয়ে নয়) নেয়ার পরও যদি টাখ্নু বা গোঁড়ালী দৃষ্টিগোচর নাহয় তবে গোঁড়ালী ঢাকা অবস্থাতেই সালাত পড়ে নেয়া উচিত। এ ভাবে সালাত পড়লে অবশ্যই সালাত মাকরূহ-ই-তানযীহী হবে। কিন্তু গোঁড়ালী দেখা যাওয়ার জন্য প্যান্ট বা পায়জামার নিচের দিকে মুড়ানোতে সালাত মাকরূহ-ই-তাহরীমী হয়। আর যে সালাত মাকরূহ-ই-তাহরীমী হয় তা পুনরায় পড়ে নেয়া ওয়াজিব। আশ্চর্যের কথা হলো, মাকরূহ-ই-তানযীহী হতে বাঁচার জন্য লোকেরা মাকরূহ-ই-তাহরীমী করে বসে আর সুন্নাতের উপর আমাল করছে বলে ধারণা করে বসে। (মু’মিন কী সালাত- পৃষ্টা-১৮০-১৮১)
লুঙ্গি পরিধান করার জন্য যেটা মুড়ানো হয় তা লুঙ্গি পরিধানের স্বাভাবিক অবস্থা। এটাকে মুড়ানোর পর্যায়ে ধরা হবে না। হ্যাঁ তবে স্বাভাবিক ভাবে মুড়িয়ে লুঙ্গি পরিধান করার পর কোমরের দিকে পুনরায় মুড়িয়ে নেয় তাহলে সেটাকে মুড়ানো বলে ধরে নেয়া হবে।
(৫) প্রশ্নঃ যদি প্যান্ট ইত্যাদি কোমরের দিক দিয়ে বা পায়ের দিক দিক দিয়ে মুড়ানো না যায় তবে এ অবস্থায় কি করতে হবে? যেহেতু কাপড় মুড়িয়ে সালাত পড়লে কাপড় স্বাভাবিক করে সালাত পুনরায় আদায় করে দেয়া ওয়াজিব হয়ে যাচ্ছে । অপরদিকে আমরা এতদিন জেনে এসেছি যে, প্যান্ট, পায়জামা, লুঙ্গি টাখ্নু বা পায়ের গোঁড়ালির নীচে হলে হারাম। এ অবস্থায় সালাত পড়া জায়েজ নেই। যদি তাই হয় তবে তো একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে যে, প্রায় লোকের প্যান্ট, পায়জামা, লুঙ্গি টাখ্নুর নীচ পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এখন ঐ ব্যক্তি তো পূর্বে উল্লেখিত বক্তব্য অনুসারে অর্থাৎকাপড় মুড়িয়ে সালাত পড়া মাকরূহ-ই-তাহরীমী প্যান্টকে কোমরের দিক দিয়ে কিংবা পায়ের দিক দিয়ে মুড়িয়ে নিতে পারছেন না আবার টাখ্নুর নীচেও রাখতে পারছেন না, এ অবস্থায় তার করণীয় কি?
উত্তরঃ এ বিষয়ের উপর দলিল পেশ করার পূর্বে কিছু কথা পেশ করছি। তা হলো প্যান্ট ইত্যাদি এত লম্বা সেলাই না করাই উচিত যা টাখ্নুর নীচে হয়। কেননা এটা শুধু সালাত অবস্থায় নয় বরং সাধারণ অবস্থায়ও ততটুকু দোষনীয় যতটুকু সালাত অবস্থায় দোষনীয়। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যা এরশাদ করেছেন তা সর্ব অস্থায় প্রযোজ্য। তা সালাতে হোক বা সালাতের বাইরে হোক। কাপড়কে টাখ্নুর নীচে পর্যন্ত পরা কে ফিক্হর পরিভাষায় ‘ইসবাল’ বলে। কাপড় অহংকারের নিয়্যাত ব্যতিত টাখ্নুর নীচে থাকাতে সালাত মাকরূহ-ই-তানযীহী। তাতে সালাত পুনরায় আদায় করে দেয়া জরুরী হয় না। ফতওয়ায়ে ‘আলমগীরীতে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘পুরুষের পায়জামা, লুঙ্গি, প্যান্ট গোঁড়ালীর নিচে পরা যদি অহংকারে না হয় তবে তা মাকরুহ-ই-তানযীহী। (ফতওয়ায়ে ‘আলমগীরী,ফাতাওয়া রযভিয়্যাহ্- খন্ড-৩য়,পৃষ্ঠা-৪৪৮)। আর যদি অহংকারের নিয়্যাতে হয় তবেই সালাত মাকরূহ-ই-তাহরীমী হবে এবং সালাত অহংকার মুক্ত হয়ে বা টাখ্নুর উপরে থাকে এমন কাপড় পড়ে পুনরায় সালাত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আদায় করে দেয়া ওয়াজিব। আমরা যা এতদিন জানতাম যে, কাপড় টাখ্নুর নীচে হলে হারাম তা সম্পূর্ণ ভাবে সঠিক নয়। বরং হাদীস শারীফের সারমর্ম হচ্ছে যে, যদি ‘খুয়ালা’ অর্থাৎ অহংকার সহকরে কাপড় টাখ্নুর নীচে পরিধান করা হয়, তবে তা হবে দোষের তাছাড়া নয়। সুতরাং হাদীসের আলোকে ফাক্বীহ্গণ রায় দিয়েছেন যে, অহংকার সহকারে কাপড় টাখ্নুর নীচে হলে মাকরূহ-ই-তাহরীমী আর অহংকার না হলে মাকরূহ-ই-তানযীহী। তবে স্মরণ রাখবেন সর্বাবস্থায় কাপড় টাখ্নুর উপর পরিধান করা পুরুষের জন্য সুন্নাত। সুতরাং অন্য জাতির অণুকরণ করে প্যান্ট, পায়জামা, লুঙ্গি ইত্যাদি টাখ্নুর নিচে পরিধানের পরিবর্তে মুসলমান হিসাবে প্রত্যেককে সুন্নাতের উপর আমল করা উচিত। এতে সালাতের মতো মূল্যবান ইবদাত নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। উপন্তু সুন্নাতের উপর আমল করার সাওয়াবও অর্জিত হবে। হাদীসে আছে-‘‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে ভালবেসেছে, সে আমাকে ভালবেসেছে, আর যে আমাকে ভালবেসেছে সে জান্নাতে আমার সাথে থাকবে’’। (মিশকাত শারীফ, পৃষ্ঠা-৩০)
অন্য হাদীসে রয়েছে- ‘‘যে ব্যক্তি উম্মতের বিপর্যয়ের সময় আমার সুন্নাহ অনুসারে কাজ করে, তাকে একশত শহীদের সাওয়াব দান করা হবে।’’ (মিশকাত শারীফ, পৃষ্ঠা-৩০)
এবার বিষয়ের দলিল সমূহ পর্যবেক্ষণ করুন। হাদীস এ রয়েছে -‘‘কাপড়ের যে অংশ টাখ্নুর নীচে হবে সে অংশটুকু জাহান্নামি হবে। (বোখারী শারীফ, খন্ড-২য়, পৃষ্ঠা-৮৬০)
হযরত আবূ যর (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী কারীম্ (সাঃ) বলেন-‘‘আল্লাহ্ তালা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না। এমন কি তাদের দিকে দয়ার দৃষ্টিতে তাকাবেন না,তাদের পরিচ্ছন্নও করবেন না । বরং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।’’ আমি হযরত আবূ যর (রাঃ) আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সাঃ) কারা গুনাহগার ও ক্ষতিগ্রস্ত? হুযূর (সাঃ) বললেন – ‘‘কাপড় টাখ্নুর নিচে যে পরিধান করে, যে উপকার করে তা দেখিয়ে দেয় এবং নিজ মালের মিথ্যা ক্বসম খেয়ে বিক্রয়কারী বা কু-কর্মকারী ফাসিক।’’ (আবূ দাঊদ শারীফ- খন্ড-২য়, পৃষ্ঠা-৫৬৫)
সায়্যিদুনা হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘‘আল্লাহতালা কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির দিকে রহমতের দৃষ্টি করবেন না যে অহংকারের সাথে নিজের পায়জামা জমিনের উপর হেঁছড়ায় অর্থাৎ এত নীচে করে নেয় যে, জমিনের সাথে লাগে বা টাখ্নুর নীচে হয়। (বোখারী শারীফ, খন্ড-২য়, পৃষ্ঠা-৮৬১)
সায়্যিদুনা মুহারিব হতে এবং তিনি সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘যে অহংকার বশতঃ কাপড় হেঁছড়ায় আল্লাহতালা তার দিকে রহমতের দৃষ্টি দেবেন না । তখন আমি মুহারিব হতে জিজ্ঞাসা করলাম যে, তিনি কি পায়জামার কথা বলেছেন? তখন মুহারিব বললেন যে , না পায়জামার কথা বলেছেন, না জামার। (বোখারী শারীফ- ২য় খন্ড,পৃষ্ঠা- ৮৬১)
এ হাদীস শরীফ হতে প্রতীয়মান হয়ে গেলো যে, সব ধরণের কাপড়, চাই জুববা হোক বা সালোয়ার , যে কোন জামা হোক না কেন সেটা টাখ্নুর নীচে হলে তার দিকে আল্লাহতালার দয়ার দৃষ্টি করবেন না। (বোখারী শারীফ- ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৮৬১)
সায়্যিদুনা ইবনে উমর (রাঃ) বলেন যে, নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন-যে, ‘ব্যক্তি নিজের কাপড় অহংকার করে নীচু করবে, আল্লাহ্তালা কিয়ামত দিবসে তার দিকে দয়ার দৃষ্টি করবেন না।’’ সয়্যিদুনা সিদ্দীকে আকবার (রাঃ) এ উচ্চমান সম্পন্ন বাণী শ্রবণ করতেই আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আমার লুঙ্গি তো নীচে লটকে যায়। কিন্তু ঐ সময় যে, যখন আমি সেটার বিশেষ খেয়াল রাখব। হুযূর (সাঃ) বললেন, তুমি তাদের মধ্যে নও যারা ইচ্ছাকৃত অহংকারের নিয়্যাতে লুঙ্গি ওখানে রাখে। অর্থাৎ এ শাস্তি তাদের জন্য যারা ইচ্ছাকৃত অহংকারের নিয়্যাতে লুঙ্গি ও সালোয়ার ইত্যাদি নীচু রাখে। এ হাদীস শারীফ হতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কাপড় পায়ের গিঁঠ হতে নীচে কেন পরা হয়। এটি ২ টা কারনে-
১- অহংকারের কারনেঃ অহংকারের কারনে পরা হলে তা হবে হারাম ও নিষিদ্ধ। এতে সালাত মাকরূহ-ই-তাহরীমী ওয়াজিবুল ইয়া’দাহ্ হয়ে যায়।
২-অহংকার ছাড়াঃ অনিচ্ছাকৃত হলে এবং অহংকার ছাড়া পরা হলে মাকরূহ-ই-তানযিহী বরঞ্চ খিলাফে আওলা (উত্তমের বিপরীত)।
যার কারণে সালাত পুনরায় পড়া ওয়াজিব হয়না। হযরত সিদ্দীক্বে আকবার (রাঃ) এর এ কাজ অহংকার এর ছিল না। কেননা তাঁর পেট মোবারকের কারণে পায়জামা নীচে নেমে যেত। এ কারণে হুযুর (সাঃ) বলেন- ওহে আবু বকর ! তুমি অহংকার করে কাপড় নীচুকারী নও। যে কোন কাপড় টাখ্নু হতে নীচে করা যেমন লুঙ্গি , জামা, সালোয়ার এবং পাগড়ী সব গুলোতেই নিষিদ্ধ।
যেমন হাদীস শরীফে রয়েছে- ‘‘যে ব্যক্তি লুঙ্গি, সালোয়ার, জামা, পাগড়ীর মধ্যে কিছুও অহংকার করে টাখ্নুর নীচে করবে , আল্লাহ্তালা কিয়ামতের দিন তার দিকে দয়ার দৃষ্টি করবেন না।’’
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, হুযূর (সাঃ) বলেছেন- যে ব্যক্তি সালাত অহংকার এর সাথে লুঙ্গিকে পায়ের গিঁঠের নীচে লটকায় তাকে আল্লাহ্তালার রহমত না-হেরেমের বাহিরে মিলবে, না-হেরেমের ভিতরে মিলবে।” (আবু দাউদ- খন্ড-১ম, পৃষ্ঠা-৯৩)
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি লুঙ্গি পরা অবস্থায় সালাত পড়ছিল, তখন হুযূর (সাঃ) ইরশাদ করলেন, যাও অযূ কর , সে গেল এবং অযূ করে ফিরে আসল। কেউ আরয করল কি হল যে, হুযূর (সাঃ) তাকে অযূর আদেশ দিলেন। ইরশাদ করলেন, সে লুঙ্গি লটকিয়ে সালাত পড়ছিল । নিঃসন্দেহে আল্লাহ্তালা ঐ ব্যক্তির সালাত কবুল করেন না , যে লুঙ্গি পরা অবস্থায় সালাত আদায় করে অর্থাৎ লুঙ্গি এত নীচে হওয়া যে টাখ্নু ঢেকে যায়। আদেশ এ জন্য দিয়েছি যে, তার যেন জানা হয়ে যায়, এটা অপরাধ। অযূ এ অপরাধের কাফ্ফারাহ্ এবং গুনাহর উপকরণকে নষ্টকারী। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাঃ) প্রতীয়মান হয় যে, হুযূর (সাঃ) বলেননি যে, উপর অথবা নীচের দিক হতে মুড়িয়ে নাও। মূল কথা প্যান্টের পা টাখ্নুর নীচে হওয়া যদি অহংকারের নিয়্যাতে হয় তাহলে হারাম এবং শরীরের ঐ জাহান্নামের আগুন হতে পরিত্রাণ পাবে না। যদি অহংকারের নিয়্যাতে না হয় তাহলে শাস্তিও হবে না।
(৬)প্রশ্নঃ এসব আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হল যে, হুযূর (সাঃ) প্যান্ট ইত্যাদি কোমর ও পায়ের দিকে এবং জামার হাতা আধা কব্জি হতে অধিক তুলে নেয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ বা একচ্ছত্র ইরশাদ করেছেন , কোন প্রকারের কারণ ইরশাদ করেননি। কাপড় টাখ্নুর নীচে পরার ব্যাপারে মাকরূহ-আ-তাহরীমী হওয়ার কারণও ইরশাদ করেছেন যে, ‘‘খুয়ালা’’ অর্থাৎ অহংকারের নিয়্যাতে হলে তবে মাকরূহ-ই-তাহরীমী হবে ও ওই অংশ জাহান্নামী হবে। অহংকার ছাড়া হলে নয়। অহংকার ছাড়া হলে নয়। কেননা অহংকার ছাড়া কাপড় টাখ্নুর নিচে হওয়ার মাকরূহ-ই-তানযীহী। সুতরাং কাপড় গুটিয়ে বা মোচড়িয়ে নেয়া অহংকারের নিয়্যাত ব্যতিত কাপড় টাখ্নুর নিচে হওয়া থেকে অধিক দূষণীয় ও ক্ষতিকারক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কারো প্যান্ট ইত্যাদি লম্বা হয় সাথে সাথে অহংকারও থাকে তবে সে প্যান্টকে গুটিয়ে বা মোচড়িয়ে নিতে পারছে না আবার টাখ্নুর নিচে রাখতে পারছে না এ অবস্থা্য় তার করণীয় কি?
উত্তরঃ প্রথমত তাকে অহংকার নামক মনের ব্যাধি থেক নিজেকে রক্ষা করতে হবে তাহলে সব সমস্যা শেষ। আর এজন্যই তাকে টাখ্নুর উপরে করে নিতে হবে। যাতে অহংকার দূর হয়ে যায়। আর যদি তা না হয় তবে অহংকার থাকার কারণে তার সালাত ম্করূহ-ই-তাহরীমী হবে। গুটিয়ে মোচড়িয়ে নেওয়ার কারণেও মাকরূহ-আ-তাহরীমী হবে। আল্লাহ পাক এর ওয়াসীলায় সঠিক মাসআলার উপর আ’মাল করার তাওফিক্ব দিন।
আমীন
0 মন্তব্যসমূহ